শুধু নামেই চলছে বাসে ই-টিকেটিং

এস এম রাজিব: রাজধানীতে অতিরিক্ত বাস ভাড়া আদায় ও শৃংখলা ফেরাতে গত বছরের ১৩ নভেম্বর থেকে ঢাকার মিরপুর অঞ্চলের ৩০টি কোম্পানির বাসে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। এছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই টিকেট ব্যবস্থা চালু করা হয় আরও ১৫টি কোম্পানির বাসে।

কিন্তু এরপর প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ই-টিকেটের মাধ্যমে যাত্রী সেবা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। শুরুতে কিছু বাসে ই-টিকিটের মাধ্যমে ভাড়া নিলেও বর্তমানে এ বিষয়ে একেবারেই অনিহা সুপারভাইজারদের।

মঙ্গলবার সকালে ফার্মগেট থেকে মিরপুর-সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন এই প্রতিবেদক। গন্তব্য ফার্মগেট থেকে শাহবাগ। বাসের সুপারভাইজার আব্দুর রহমান ভাড়া চাইলেন ১০ টাকা। ই-টিকিট চাইলে তিনি বলেন, ‘মেশিনে চার্জ নেই, তাই মেশিন চার্জে দিয়ে আসা হয়েছে।’

রাতে চার্জ দেননি কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাতে বিদ্যুৎ ছিল না।’

এ বিষয়ে কথা হয় ওই বাসের যাত্রী হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। ভোক্তাকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘মেশিনে চার্জ না থাকার বিষয়টি সঠিক নয়। কারণ বিহঙ্গ বাসে আমি প্রায় দিনই যাতায়াত করি। তারা টিকেটই দেয় না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই টিকেট চেয়ে নেওয়া উচিৎ। কিন্তু তারা না দিলে কি করার আছে, ঝগড়া করে তো আর নেওয়া যায় না।’

একই পরিস্থিতি মিরপুর-যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকৃত শিকড় পরিবহনেও। কারওয়ান বাজার থেকে শিকড়ের একটি বাসে উঠা হলো, গন্তব্য খামারবাড়ি। সুপারভাইজার মো. তরিকুল ইসলাম চাইলেন ১০ টাকা। টিকেট চাইলে তিনি বলেন, ১০ টাকায় টিকেট দিতে হয় না।

কিন্তু সবাইকেই তো টিকেট দেওয়ার নিয়ম আর যারা ২০/৩০ টাকা দিচ্ছে তাদেরও তো কোনো টিকেট দিচ্ছেন না- এমন প্রশ্নে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর চালকের সিট থেকে ডিভাইস এনে টিকেট দিতে শুরু করলেন যাত্রীদের।

টিকেট দেন না কেন জানতে চাইলে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘টিকেট দিতে গেলে ভাড়া তুলতে সময় বেশি লাগে, তাই দেই না।’

তবে টিকেট না দেওয়ার কারণ হিসেবে ওই বাসে থাকা মাহবুব মোর্শেদ নামক এক যাত্রী বলেন, ‘প্রতিটি টিকেট থেকে সরকার কমিশন পায়। আবার টিকেট ছাড়া ভাড়াও বেশি নেওয়া যায়। কারণ অনেকেই প্রকৃত ভাড়া সম্পর্কে জানে না। যার কারণে টিকেট দেয় না তারা।’

একই বাসের যাত্রী ষাটোর্ধ মো. মজিদ বিশ্বাস বলেন, ‘আপনাকে দেখে তারা টিকেট দিয়ে ১০ টাকা নিল, কিন্তু আগারগাঁও পর্যন্ত এতদিন ১৫ টাকা করে নিত।’

ভোগান্তির শেষ নেই শিক্ষার্থীদেরও। তাদের জন্যে হাফ ভাড়া নেওয়ার নিয়ম থাকলেও ভাড়া দিতে গিয়ে লাঞ্ছিতের শিকার হতে হয়। শিকরের ওই বাসে থাকা একজন নারী যাত্রী তার ৭/৮ বছরের মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিলেন। নিজের ভাড়ার সঙ্গে মেয়ের হাফ ভাড়া দিতে গেলে বাধে বাগবিতণ্ডা। কারণ সুপারভাইজার তার স্কুল কার্ড দেখতে চান। আর ওই মায়ের মতে, স্কুল ড্রেস থাকার পরও কেন কার্ড দেখতে চাইবে।

একই বাসে থাকা একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রবিন ইসলাম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘বাসে হাফ ভাড়া দিতে গেলে অপমানিত হতে হয়। যেমন ১০ টাকার কম ভাড়া নেয় না, সিটে বসে হাফ ভাড়া দিলে টিটকারি করে, সন্ধ্যা লাগলেই আর হাফ ভাড়া নেয় না। কিন্তু ক্যাম্পাস থেকে তো অনেক সময়ই দেরিতে বের হতে হয়। আবার সরকারি ছুটির দিনেও স্টুডেন্ট ভাড়া নেয় না।’

ঢাকা নগর পরিবহনের যাত্রাবাড়ী জনপথ মোড়ের এক টিকেট চেকারের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির নিয়ম হচ্ছে নির্দিষ্ট স্টপেজের বাইরে গেট খোলা যাবে না এবং স্টপেজ ছাড়া লোকও তোলা যাবে না। আর বাসে ওঠার আগে অবশ্যই ই-টিকিট নিয়ে উঠতে হবে। কারণ বাসে ভাড়া নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কিছু বাসের চালক আর সুপারভাইজার যেখানে সেখানে লোক ওঠায়। এই ভাড়া পরিবহন কোম্পানি পায় না। তারা নিজেরাই নেয়। যার কারণে কোম্পানি ক্ষতির মুখে পড়ছে।’

এছাড়াও, রাজধানীতে চলাচল করা বিকল্প পরিবহন, মিরপুর সুপার লিংক, স্বাধীন লাইন পরিবহন, দেওয়ান এন্টারপ্রাইজ, গাবতলী এক্সপ্রেস, রমজান এন্টারপ্রাইজ, মিডলাইন পরিবহনের বেশ কিছু বাসে ই-টিকেট না দিয়েই ভাড়া নিতে দেখা গেছে। তবে এসব পরিবহনের কিছু বাসে নিয়ম অনুযায়ী টিকেট দিয়েই ভাড়া নিতে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ই-টিকেট সিস্টেম কার্যকর রাখার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে প্রতিদিন চারটি টিম কাজ করছে। তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মনিটরিং করছে। যারা টিকেট দিচ্ছে না তাদেরকে জরিমানা করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাত্রী সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে এর জন্যে যাত্রীদেরকেও সোচ্চার হতে হবে। তারা যেন টিকেট না নিয়ে ভাড়া না দেয়, প্রয়োজনে অভিযোগ জানাতে পারে।’

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যাত্রী সার্ভিস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি বাসে এই ইলেকট্রিক ডিভাইসগুলো সরবরাহ করেছে। এই ডিভাইসের মাধ্যমে যতো টিকেট কাটা হবে তার ১.৫ টাকা কমিশন পাবে সেই কোম্পানি। আর কোম্পানির ওই আয় থেকে সরকার একটা রাজস্ব পায় বলে ধারণা করছি। অর্থাৎ ই-টিকেট না দিয়ে ভাড়া নেওয়ায় কোম্পানি ও রাষ্ট্র কমিশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

রাজধানীতে অতিরিক্ত বাস ভাড়া আদায় নিয়ে বিভিন্ন সময় যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিরসনে ই-টিকেটিংয়ের উদ্যোগ নেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় ঠেকাতে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরীক্ষামূলক ভাবে আটটি পরিবহন কোম্পানিতে ই-টিকেটিং চালু হয়। এরপর ১৩ নভেম্বর আরও ২২টিসহ মোট ৩০ কোম্পানির এক হাজার ৬৪৩টি বাসে ই-টিকেটিং সিস্টেম চালু হয়।

এছাড়াও, চলতি বছরের জানুয়ারিতে আরও ১৫টি কোম্পানির ৭১১টি বাসে ই-টিকেটিং চালু করা হয়। এতে সরকার নির্ধারিত হারে একজন যাত্রী যত কিলোমিটার যাবেন, তিনি ঠিক তত দূরত্বের জন্যই ভাড়া দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু বাস্তবে এর মিল পাওয়া যায় না।